প্রকৃতির অলংকার, উজ্জ্বল ডানা আর দ্রুতগতির উড়ানের জন্য আমরা ফড়িংকে চিনলেও, এর জীবনের সবচেয়ে রহস্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি লুকিয়ে আছে পানির নিচে। আজ আমরা কথা বলব আমাদের চেনা-অচেনা একটি প্রজাতি – বাদামি গাছ ফড়িং বা ব্রাউন এম্পেরর ড্রাগনফ্লাইয়ের জীবনচক্র নিয়ে। এই যাত্রা হবে অদ্ভুত, জটিল এবং চমকপ্রদে ভরা।
জীবনচক্রের সংক্ষিপ্ত রূপ: চারটি ধাপ
অন্যান্য ফড়িংয়ের মতোই বাদামি গাছ ফড়িংয়ের জীবনচক্র সম্পূর্ণ রূপান্তর (হোলোমেটাবোলাস) এর মাধ্যমে হয়। এর মানে এটি চারটি স্পষ্ট ধাপ পার করে:
1. ডিম (Egg)
2. নিম্ফ/লার্ভা (Nymph/Larva)
3. পিউপা/প্রাক-প্রাপ্তবয়স্ক (Pupa)
4. প্রাপ্তবয়স্ক ফড়িং (Adult Dragonfly)
এখন এই প্রতিটি ধাপই আসলে একটি সম্পূর্ণ গল্প।
---
১. প্রথম অধ্যায়: ডিমের সূচনা
জীবনচক্র শুরু হয় একটি মিলন নৃত্য দিয়ে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ফড়িং তার এলাকা দখল করে রাখে এবং একটি স্ত্রী ফড়িংকে আকর্ষণ করে। মিলনের পর, স্ত্রী ফড়িংটি পানি ভর্তি কোনো স্থানে, যেমন পুকুর, নদীর ধারের গাছের ডাল, ভাসমান পাতার নিচের অংশে বা ভেজা কাদায় একেকটি করে ডিম পাড়ে। সে তার ডিমবিহীন পেট ব্যবহার করে পানির কাছাকাছি কোনো উদ্ভিদের কাণ্ড বা কাদায় ছিদ্র করে সেখানে ডিম রাখে। কখনো কখনো সে উড়ন্ত অবস্থায়ই পানি স্পর্শ করে ডিম ছেড়ে দেয়।
এই ডিমগুলো আকারে অত্যন্ত ক্ষুদ্র, প্রায় দানাদার চিনির দানার মতো। এগুলো একটি জেলির মতো পদার্থ দ্বারা আবৃত থাকে যা পানির সংস্পর্শে ফুলে উঠে এবং ডিমগুলোকে রক্ষা করে। এই ডিম ফুটে বের হতে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাসও লাগতে পারে, পরিবেশের তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে।
২. দ্বিতীয় অধ্যায়: নিম্ফ – পানির নিচের অদৃশ্য শিকারী
ডিম ফুটে বের হয় নিম্ফ, যা দেখতে সম্পূর্ণ আলাদা – একটি ছোট্ট, আঠালো, প্রায় ভিনগ্রহের প্রাণীর মতো। এটি হল জীবনচক্রের দীর্ঘতম যা এক থেকে দুই বছর স্থায়ী হতে পারে! বাদামি গাছ ফড়িংয়ের নিম্ফ পুরো সময়টাই কাটায় পানির নিচে, পাথর, কাদা বা পানিতে ডুবে থাকা গাছের ডালের ফাঁকে লুকিয়ে থেকে।
নিম্ফের জীবনই হলো একটি নিখুঁত শিকারের জীবন:
· রূপ: এর শরীর বাদামি বা মেটে রঙের, যা পানির তলার পরিবেশের সাথে মিশে যেতে সাহায্য করে। এদের একটি বিশেষ মুখparts আছে, যাকে "মাস্ক" (Mask) বলে। এটি একটি ভাঁজ করা, দাঁতযুক্ত হাত যা শিকার ধরে রাখতে পারে।
· শিকার পদ্ধতি: নিম্ফ অত্যন্ত ধৈর্য্যের সাথে শিকারের জন্য অপেক্ষা করে। যখন কোনো ছোট মাছ, পোকা, মশার লার্ভা বা অন্য কোনো জলজ প্রাণী কাছ দিয়ে যায়, তখন সে বিদ্যুতের গতিতে তার মাস্ক ছুঁড়ে মারে এবং শিকারকে আঁকড়ে ধরে।
· বৃদ্ধি: বড় হতে হলে নিম্ফকে নিজের শক্ত খোলসটি বারবার খসিয়ে ফেলতে হয়, একে বলে "মোল্টিং" বা খোলস পরিবর্তন। এই দুই বছরে এটি ১০-১২ বার পর্যন্ত খোলস বদলাতে পারে।
৩. তৃতীয় অধ্যায়: রূপান্তরের মুহূর্ত – প্রাক-প্রাপ্তবয়স্ক
দীর্ঘ নিম্ফ জীবন শেষে, যখনই তা পরিপক্ব হয় এবং পরিবেশ অনুকূল হয় (সাধারণত বসন্ত বা গ্রীষ্মে), তখন এটি পানির বাইরে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। এটি পানিতে ডুবে থাকা কোনো কাণ্ড, দড়ি বা পাথর বেয়ে উপরে উঠে আসে।
এরপর শুরু হয় জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় রূপান্তর। নিম্ফ তার পিঠের খোলস ফাটিয়ে বের হওয়ার জন্য জোর দিতে থাকে। ধীরে ধীরে একটি প্রাপ্তবয়স্ক ফড়িংয়ের মাথা, বুক,পা বেরিয়ে আসে। শেষে, তার নরম, ভাঁজ করা ডানাগুলো বের করে আনে এবং সেগুলোতে রক্ত সঞ্চালন করে সেগুলো প্রসারিত ও শক্ত করে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি কয়েক ঘন্টা ধরে চলে। এই সময়টায় এটি অত্যন্ত Vulnerable বা নিরাপত্তাহীন থাকে, কারণ এর শরীর নরম এবং উড়তে অক্ষম। এটি শিকারি পাখি বা অন্যান্য প্রাণীর সহজ শিকারে পরিণত হতে পারে।
৪. চতুর্থ অধ্যায়: প্রাপ্তবয়স্ক – আকাশের দখলদার
ডানা শুকিয়ে শক্ত হওয়ার পর, বাদামি গাছ ফড়িং তার প্রথম উড়ান দেয়। এখন এটি আমরা চিনি সেই সুন্দর পতঙ্গে পরিণত হয়েছে।
· চেহারা: প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ফড়িংয়ের শরীর গাঢ় বাদামি বা তামাটে রঙের হয়, সাথে সোনালি বা হলদেটে দাগ থাকতে পারে। স্ত্রী ফড়িংয়ের রং একটু ফ্যাকাশে হয়। উভয়েরই ডানা স্বচ্ছ, যার গোড়ার দিকে একটি স্পষ্ট অ্যাম্বার বা বাদামি রঙের পট্টি থাকে, যা এদের শনাক্ত করার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।
· আচরণ: প্রাপ্তবয়স্ক ফড়িংয়ের জীবন খুবই ছোট, মাত্র কয়েক সপ্তাহ। এই সময়টায় তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয় প্রজনন। পুরুষ ফড়িংগুলো একটি নির্দিষ্ট এলাকা (Territory) দখল করে এবং অন্য পুরুষদের তাড়িয়ে বেড়ায়। তারা উড়ে উড়ে মশা, মাছি, প্রজাপত ছোট পোকা শিকার করে। তাদের উড়ান অত্যন্ত দ্রুত ও নিপুণ।
· প্রজনন: পুরুষ ফড়িং স্ত্রী ফড়িংকে আকর্ষণ করে এবং মিলন ঘটে। মিলনের পর, জীবনচক্রের বৃত্তটি সম্পূর্ণ করতে স্ত্রী ফড়িং আবারও পানি ভর্তি জায়গায় ডিম পাড়ে। এরপরই সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক ফড়িংগুলোর জীবনcycles সম্পন্ন হয়।
প্রকৃতির ভারসাম্যে তাদের ভূমিকা
বাদামি গাছ ফড়িং আমাদের পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
· নিম্ফ হিসেবে: তারা পানির নিচে মশার লার্ভা ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ খেয়ে জলাশয় পরিষ্কার রাখে এবং মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে helps করে।
· প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে: তারা বাতাসে উড়ন্ত মশা, মাছি ক্ষতিকর পোকামাকড় শিকার করে, যা প্রাকৃতিক বালাই নিয়ন্ত্রণএকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
উপসংহার
বাদামি গাছ ফড়িংয়ের জীবনচক্র প্রকৃতির একটি অসাধারণ নিদর্শন। এটি আমাদের শেখায় যে, রূপান্তর ও ধৈর্যের মাধ্যমে ছোট্ট একটি ডিম থেকে কীভাবে একজন দক্ষ শিকারীতে পরিণত হওয়া যায়। পরেরবার যখন আপনি কোনো পুকুরের ধারে এই বাদামি রঙের ফড়িংটিকে উড়ে বেড়াতে দেখবেন, তখন একবার ভাববেন, এই সুন্দর প্রাণীটি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছে পানির নিচে, একটি ভয়ঙ্কর শিকারী হিসেবে। এটি প্রকৃতিরই আরেকটি বিস্ময়।

0 Comments